মানবাধিকারের দলিল বিদায় হজের ভাষণ

বিশ্বমানবতার জন্য শান্তি-মুক্তি ও কল্যাণের বার্তা নিয়ে এসেছিলেন প্রিয় নবি হজরত মুহাম্মাদ মোস্তফা (সা.)। মানুষের অধিকার, মর্যাদা ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় তার তুলনা তিনি নিজেই। তিনি শেষ নবি। আসমানি শেষ গ্রন্থ কুরআনের প্রচারে তিনি নিজেকে উৎসর্গ করেছেন। দীর্ঘ তেইশ বছর ধরে নানা ঘাত-প্রতিঘাত ও বাধা-বিপত্তি ডিঙিয়ে তিনি ইসলামকে পরিপূর্ণ জীবনবিধান হিসাবে বিশ্ববাসীর কাছে উপস্থাপন করে গেছেন। তার দেখানো পথে রয়েছে আজকের ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ পৃথিবীর জন্য প্রতিশেধক। শান্তি ও মুক্তির মহৌষধ। বিদায় হজের ভাষণে তিনি তার আগমনের মূল উদ্দেশ্য পূর্ণাঙ্গরূপে মানুষের কাছে তুলে ধরেন। ঘোষণা করেন মানবতার মুক্তির ইশতেহার।

দশম হিজরি রাসূল (সা.) সপরিবারে পবিত্র হজের লক্ষ্যে মদিনা থেকে মক্কার উদ্দেশে রওনা করেন। সোয়া লাখ সাহাবার কাফেলা নিয়ে পবিত্র কাবার প্রাঙ্গণে পৌঁছান। এটাই তাঁর জীবনের প্রথম ও শেষ হজ। কাতাদা (রহ.) থেকে বর্ণিত, আমি আনাস (রা.)-কে জিজ্ঞেস করলাম, আল্লাহর রাসূল (সা.) কতবার ওমরাহ আদায় করেছেন? তিনি বলেন, চারবার। তন্মধ্যে হুদায়বিয়ার ওমরাহ জুলকাদা মাসে যখন মুশরিকরা তাঁকে মক্কায় প্রবেশ করতে বাধা দিয়েছিল। পরবর্তী বছরের জুলকাদা মাসের ওমরাহ, যখন মুশরিকদের সঙ্গে চুক্তি সম্পাদিত হয়েছিল, জিরানার ওমরাহ, যেখানে নবি (সা.) গনিমতের মাল, সম্ভবত হুনায়নের যুদ্ধে বণ্টন করেন। আমি বললাম, আল্লাহর রাসূল (সা.) কতবার হজ করেছেন? তিনি বলেন, ‘একবার’। (বুখারি-১৭৭৮)।

বিদায় হজের ঐতিহাসিক ভাষণে রাসূল (সা.) সবচেয়ে বেশি বলেছেন মানুষের অধিকারের কথা। সাম্য-শান্তি, সম্মান ও মুক্তির কথা। মানবতার মুক্তির দলিলখ্যাত বিদায় হজের ভাষণে রাসূল (সা.) দাস-দাসীর অধিকারের বিশদ বিবরণ থেকে শুরু করে বংশীয় কৌলীন্য ও বর্ণবাদের বিলুপ্তি, নারী মুক্তির পথ, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষাসহ জাতীয় আন্তর্জাতিক জীবনের আগত ও অনাগত অগণিত সংকটের সমাধান দিয়ে গেছেন। নিম্নে বিদায় হজের ভাষণের চুম্বকাংশ তুলে ধরা হলো-

বংশীয় কৌলীন্য ও বর্ণবাদের অবসান

হে লোকসকল! আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে মানবজাতি! আমি তোমাদের এক পুরুষ ও এক নারী থেকে সৃষ্টি করেছি এবং তোমাদের বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি, যাতে তোমরা পরস্পরে পরিচিত হতে পার। নিশ্চয় আল্লাহর কাছে সেই সর্বাধিক সম্মানিত, যে সর্বাধিক পরহেজগার। (সূরা হুজুরাত, ১৩)। সুতরাং কোনো অনারবের ওপর কোনো আরবের; কোনো আরবের ওপর কোনো অনারবের, এমনিভাবে শ্বেতাঙ্গের ওপর কৃষ্ণাঙ্গের এবং কৃষ্ণাঙ্গের ওপর শ্বেতাঙ্গের কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই; তবে তাকওয়ার ভিত্তিতে। সব মানুষ আদম (আ.)-এর সন্তান; আর আদম (আ.) মাটি দ্বারা সৃষ্ট।

ভ্রাতৃত্ববোধ প্রতিষ্ঠা

হে সভ্যমণ্ডলী! এক মুসলমান অপর মুসলমানের ভাই, সব মুসলমান পরস্পর ভাই ভাই; তোমাদের অধীনদের (দাস-দাসী) প্রতি খেয়াল রাখবে, তোমরা যা খাবে তাদের তা খাওয়াবে, তোমরা যা পরবে তাদেরও তা পরাবে। দাস-দাসীর প্রতি সর্বদা সদ্ব্যবহার কর। তাদের ওপর কোনো ধরনের অত্যাচার করো না। তোমরা যা খাবে তাদেরও তা-ই খাওয়াবে; যা পরবে তা-ই পরাবে। ভুলো না, তারাও তোমাদের মতো মানুষ।

ধর্মীয় সম্প্রীতি রক্ষা

সাবধান! ধর্মের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করবে না; কেননা তোমাদের পূর্ববর্তী লোকেরা ধর্মীয় বিষয়ে বাড়াবাড়ি করার কারণে ধ্বংস হয়ে গেছে।

আল্লাহর ইবাদত

‘হে লোকসকল! তোমরা তোমাদের রবের ইবাদত করবে; পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়বে, রমজান মাসে রোজা রাখবে, সন্তুষ্টচিত্তে সম্পদের জাকাত প্রদান করবে, স্বীয় প্রভুর ঘরে এসে হজ পালন করবে এবং নেতাদের আনুগত্য করবে; তাহলে তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে।

‘হে আমার প্রিয় ভ্রাতৃবৃন্দ! আজ যে কথা তোমাদের বলব তা মনোযোগ দিয়ে শোনো। আমার আশঙ্কা হচ্ছে, তোমাদের সঙ্গে একত্রে হজ করার সুযোগ আর আমার ঘটবে না।

অন্ধকার যুগের কুপ্রথা বাতিল

‘হে মুসলিম! আঁধার যুগের সব ধ্যানধারণাকে ভুলে যাও, নব আলোকে পথ চলতে শেখ। আজ থেকে অতীতের সব মিথ্যা সংস্কার, অনাচার পাপ-প্রথা বাতিল হয়ে গেল। মনে রেখ, সব মুসলমান ভাই ভাই। কেউ কারও চেয়ে ছোট নও, কারও চেয়ে বড় নও। আল্লাহর চোখে সবাই সমান।

নারী অধিকার

নারী জাতির কথা ভুলো না। নারীর ওপর পুরুষের যেমন অধিকার আছে, পুরুষের ওপর নারীরও তেমন অধিকার আছে। তাদের প্রতি অত্যাচার করো না। মনে রেখ, আল্লাহকে সাক্ষী রেখে তোমরা তোমাদের স্ত্রীদের গ্রহণ করেছ। অচিরেই তোমরা তোমাদের মহান প্রভুর সাক্ষাতে উপনীত হবে। তখন তিনি তোমাদের কৃতকর্ম সম্পর্কে জিজ্ঞেস করবেন।

সুদের লেনদেন বাতিল

তোমাদের কারও কাছে যদি কোনো আমানত গচ্ছিত থাকে, তা তার প্রাপকের কাছে অবশ্যই পৌঁছে দেবে। নিশ্চয়ই সব ধরনের সুদ রহিত করা হলো। তবে তোমাদের মূলধন বহাল থাকবে। তোমরা কোনো জুলুম করবে না, তোমাদের প্রতিও কোনো জুলুম করা হবে না। জাহেলি যুগের যত রক্তের দাবি তা সব রহিত করা হলো। প্রথম আমি রবিয়া ইবনে হারিস ইবনে আবদুল মুত্তালিবের শিশুপুত্রের রক্তের দাবি রহিত করলাম।

নেতৃত্বের প্রতি আনুগত্য

হে মুসলমানগণ! হুঁশিয়ার! নেতৃত্বের-আদেশ কখনো লঙ্ঘন করো না। যদি কোনো ‘কর্তিত নাসা কাফ্রি ক্রীতদাসকে’ও তোমাদের আমির করে দেওয়া হয় এবং সে যদি আল্লাহর কিতাব অনুসারে তোমাদের পরিচালনা করে, তবে অবনত মস্তকে তার আদেশ মেনে চলবে।

কল্যাণের ডাক

সাবধান! পৌত্তলিকতার পাপ যেন তোমাদের স্পর্শ না করে। শিরক করো না, চুরি করো না, মিথ্যা কথা বলো না, জেনা-ব্যভিচার কর না। সর্বপ্রকার মলিনতা থেকে নিজেকে মুক্ত করে পবিত্রভাবে জীবনযাপন কর। চিরদিন সত্যাশ্রয়ী হয়ো। মনে রেখ, একদিন তোমাদের আল্লাহর কাছে ফিরে যেতেই হবে। সেদিন তোমাদের কৃতকর্মের জন্য জবাবদিহি করতে হবে। বংশের গৌরব কর না। যে ব্যক্তি নিজ বংশকে হেয় মনে করে অপর এক বংশের নামে আত্মপরিচয় দেয়, আল্লাহর অভিশাপ তার ওপর নেমে আসে।

‘হে মানবজাতি! তোমরা আমার কথা শোন ও অনুধাবন করো। তোমরা অবশ্যই জেনে রেখ, প্রত্যেক মুসলিম অপর মুসলিমের ভাই এবং মুসলমানরা ভ্রাতৃপ্রতিম। সুতরাং কোনো মুসলিমের জন্য তার ভাইয়ের কোনো কিছু বৈধ নয়, যতক্ষণ না সে সন্তুষ্টচিত্তে তাকে তা প্রদান করে। অতএব, তোমরা নিজেদের প্রতি জুলুম কর না।

সাফল্যের পথ

‘হে আমার উম্মত! আমি যা রেখে যাচ্ছি (কুরআন-সুন্নাহ), তা যদি তোমরা দৃঢ়ভাবে ধারণ করে থাক, তবে কিছুতেই তোমাদের পতন হবে না। সেই গচ্ছিত সম্পদ কী? তা আল্লাহর কুরআন এবং তাঁর রাসূলের সুন্নাহ। নিশ্চয় জেন, আমার পর আর কেউ নবি নেই। আমিই শেষ নবি। যারা উপস্থিত আছ, তারা অনুপস্থিত সব মুসলমানের কাছে আমার এসব বাণী পৌঁছে দিও। হয়তো অনেক অনুপস্থিত লোক উপস্থিত শ্রোতা অপেক্ষা অধিক হেফাজতকারী হবে।’

বলতে বলতে প্রিয় নবি (সা.)-এর মুখমণ্ডল আলোকিত হয়ে উঠল-কণ্ঠস্বরে নেমে এলো করুণ সুর। আকাশের দিকে তাকিয়ে তিনি আবেগভরে বলতে লাগলেন, ‘হে আল্লাহ! হে আমার প্রভু! আমি তোমার বাণী পৌঁছে দিতে পারলাম? আমি কি আমার কর্তব্য সম্পাদন করতে পারলাম?’ লাখো কণ্ঠে ধ্বনিত হলো: ‘নিশ্চয়ই! নিশ্চয়ই!’ তখন প্রিয় নবি (সা.) বলতে লাগলেন, ‘প্রভু হে! শ্রবণ কর, সাক্ষী থাক; এরা বলছে, আমার কর্তব্য আমি পালন করেছি।’ তখন পবিত্র কুরআনের শেষ আয়াত নাজিল হলো, ‘হে মুহাম্মাদ (সা.) আজ আমি তোমার দ্বীনকে সম্পূর্ণ করলাম এবং তোমার ওপর আমার নিয়ামত পূর্ণ করে দিলাম; ইসলামকেই তোমার ধর্ম বলে মনোনীত করলাম।’ (সূরা মায়িদাহ-৩)।

Jamuna Electronics
Suleman Miah দ্বারা

সম্পর্কিত পোস্ট

bn_BD