মুমিন হৃদয়ের গভীরতম ভালোবাসার প্রতীক মদিনা। এখানে শুয়ে আছেন প্রিয় নবী মুহাম্মাদ রাসূলুল্লাহ (সা.)। তার কারণেই এ শহর হয়ে উঠেছে প্রেমের মদিনা, প্রাণের মদিনা। মদিনার প্রতিটি অলিগলি, প্রতিটি ধূলিকণা যেন নবীর স্মৃতিতে পূর্ণ। এ শহরের বাতাসে মিশে আছে নবীজির সুবাস। যা মুমিনদের হৃদয়ে এনে দেয় প্রশান্তি ও উচ্ছ্বাস। কবি কাজী নজরুল ইসলাম তার কবিতায় লিখেছেন-
‘ওহে মোর সোনার মদিনা,
তুমি আমার খোদার কাছে সারা জীবনের পাওনা।
আর কিছু পাইবা না পাই, তোমার ধুলা চাই,
তোমার ধুলা গায়ে মেখে পাপ মুছিতে চাই।’
মদিনা আমাদের আত্মার প্রশান্তি, আমাদের ভালোবাসার কেন্দ্র। আল্লাহতায়ালা কুরআনুল কারিমে এ পবিত্র ভূমিকে অসংখ্য নামে সম্বোধন করেছেন। ‘আরদুল্লাহ’ অর্থাৎ আল্লাহর ভূমি, ‘আরদুল হিজর’ অর্থাৎ হিজরতের ভূমি। এই নামগুলো মদিনার মর্যাদা ও তাৎপর্যের সাক্ষী। দুনিয়ার বুকে মদিনা মুনাওয়ারার মতো এত অধিক নামবিশিষ্ট আর কোনো জনপদ নেই। যদিও হজের রুকন হিসাবে মদিনার জিয়ারত ফরজ নয়, তবুও মদিনার প্রতি মুমিনের গভীর প্রেম তাকে জিয়ারতের জন্য অনুরক্ত করে, এমনকি পাগলপারা আত্মহারায় পরিণত হয়। যুগে যুগে প্রিয় নবী (সা.)-এর আশেক বান্দারা এ ভালোবাসার স্বাক্ষর রেখেছেন।
হজরত ইমাম মালিক (রহ.) মদিনাকে দুনিয়ার সব শহরের সেরা ও সর্বোত্তম শহর বলে অভিহিত করেছেন। শুধু তাই নয়, তিনি মদিনায় মৃত্যুকামনায় সমগ্র জীবনে একবার মাত্র হজ সম্পাদন করেন। এ শহর পবিত্র নবীর পবিত্র চরণের আশীর্বাদে ধন্য হয়ে প্রতিটি অলিগলি তার সুবাস মিশে আছে। এখানকার বাতাসে তার শ্বাস-প্রশ্বাসের কোমল ছোঁয়া বিরাজমান।
আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘মদিনার প্রবেশপথে ফেরেশতারা পাহারা দেয়, এখানে প্লেগ ও দাজ্জাল প্রবেশ করতে পারে না’ (মুসলিম)। মদিনাকে হাঁপরের সঙ্গে তুলনা করে বলেন, ‘হাঁপর নিজেকে পরিষ্কার রাখে, অবর্জনা দূর করে; মদিনাও তেমনি, এখানে ভালোবাসা ও পবিত্রতা বিরাজ করে’ (মুসলিম)।
নবী করিম (সা.) বলেন, ‘যেমন ইবরাহিম (আ.) মক্কাকে হারাম ঘোষণা করে মক্কাবাসীদের জন্য দোয়া করেছেন, আমি মদিনাকেও হারাম ঘোষণা করছি এবং এখানে মক্কায় যেভাবে বরকত রয়েছে, তার দ্বিগুণ বরকতের জন্য দোয়া করছি’ (মুসলিম)। তিনি আরও প্রার্থনা করেন, ‘হে আল্লাহ! আপনি মক্কায় যে বরকত দিয়েছেন, মদিনায় তার চেয়ে দ্বিগুণ বরকত দিন’ (বুখারি)।
আনাস (রা.) বর্ণনা করেন, নবী (সা.) যখন সফর শেষে মদিনার দেওয়ালগুলোকে দেখে থাকতেন, তখন তিনি এতটাই মদিনাকে ভালোবাসতেন যে, তার বাহন উষ্ট্রীকে দ্রুত হাঁকাতেন। এমনকি অন্য কোনো জন্তুর ওপর থাকলেও তাকে দ্রুত হাঁকাতেন (বুখারি)।
তাবুক থেকে ফেরার পথে মদিনা দৃষ্টিগোচর হলে তিনি বলতেন, ‘এটা হচ্ছে তাবাহ্, আর এটা হচ্ছে উহুদ। উহুদ এমন পাহাড়, যা আমাদের ভালোবাসে আর আমরাও তাকে ভালোবাসি’ (মুসলিম)। তিনি এতটাই মদিনার প্রতি অনুরক্ত ছিলেন যে বলতেন, ‘যার পক্ষে সম্ভব, সে যেন মদিনায় মৃত্যুবরণ করে। কেননা মদিনায় মৃত্যুবরণকারীদের জন্য আমি শাফায়াত করব’ (তিরমিজি)।
নবী করিম (সা.) নিজেই প্রার্থনা করতেন, ‘হে আল্লাহ! আমার ইন্তেকাল যেন এ পবিত্র মদিনায় হয়।’ তার এই ভালোবাসা তার ওফাতের পরও বজায় আছে, যা হাদিসে প্রতিফলিত হয়েছে। তিনি বলেন, ‘কিয়ামতের ময়দানে সর্বপ্রথম আমার শাফায়াত লাভ করবে মদিনাবাসী’ (বুখারি)।
হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘কিয়ামতের সময় পৃথিবীর ধ্বংসক্রিয়া চলাকালে মদিনা মুনাওয়ারা সবচেয়ে পরে ধ্বংস হবে’ (তিরমিজি)।
মদিনা শুধু একটি শহর নয়, এটি এমন এক মহান সত্তার বসবাসস্থল, যার ওসিলায় রহমত বর্ষিত হয়, যার মাধ্যমে ইবাদত গ্রহণ হয়। মদিনায় এসে রওজা শরিফে সালাম দিলে তা উত্তর পায়, রওজার পাশে দোয়া কবুল হয়। মদিনার সঙ্গে রয়েছে মুমিনের ইমান, প্রেম, কলেমা ও মুক্তির এক অদ্ভুত সম্পর্ক। মদিনা মুনাওয়ারা এমন এক শহর, যেখানে হৃদয়ের সর্বোচ্চ শান্তি, আত্মার গভীর আনন্দ ও প্রেমের অপরিসীম আবেগ বিরাজ করে।
এ শহরটি নবীর শহর, নবীর স্মৃতি, নবীর আদর্শের মূর্ত প্রতীক। যুগে যুগে যে ভালোবাসার দ্যুতি ছড়িয়েছে, তা আজও আমাদের হৃদয়ে অমলিন থেকে যায়। মদিনা মুনাওয়ারা একটি অনুভূতি, একটি প্রেমের নাম, যা প্রতিটি মুমিনের আত্মাকে জড়িয়ে ধরে। এখানে আসা মানেই নিজেকে নবায়ন করা, জীবনের নতুন করে অর্থ খোঁজা।
মদিনা মুনাওয়ারা ইসলামের ইতিহাসের এক অমূল্য রত্ন, যা যুগে যুগে মুমিনদের হৃদয়ে অম্লান ভালোবাসার প্রতীক হয়ে থাকবে, নবী (সা.)-এর স্মৃতির সঙ্গে একাত্ম হয়ে, অবিরত আলোকিত করবে পথচলার প্রত্যেক ধাপ। এ পবিত্র ভূমি, যেখানে শান্তি, ইমান, ও আত্মিক মুক্তি একসঙ্গে বাস করে, সেই মদিনার প্রতি মুমিনের ভালোবাসা চিরন্তন, অবিনশ্বর।